logo
ads

দুর্গাপূজা: দেবতা–অসুর সংঘর্ষ নাকি আর্য–অনার্য দ্বন্দ্ব?

হিরণ্ময় হিমাংশু

প্রকাশকাল: ১ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:০৫ পি.এম
দুর্গাপূজা: দেবতা–অসুর সংঘর্ষ নাকি আর্য–অনার্য দ্বন্দ্ব?

বাংলাদেশ ও ভারতের বাঙালি হিন্দুদের  অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। প্রতি বছর আশ্বিন মাসে যখন শারদীয় দুর্গোৎসবের ঢাক বাজতে শুরু করে, তখন ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে আনন্দ আর ভক্তির আবহ। কিন্তু এই পূজার পেছনের পৌরাণিক কাহিনি কেবল দেবতার শক্তির জয়গাথা নয়, এর ভেতরে লুকিয়ে আছে প্রাচীন ইতিহাস ও নৃতাত্ত্বিক বাস্তবতার কিছু দিক। দেবতা বনাম অসুরের লড়াইয়ের আড়ালে আসলে কি আর্যদের সঙ্গে অনার্যদের সংঘর্ষই প্রতিফলিত হয়েছে? এই প্রশ্ন বহু গবেষকের আলোচনায় উঠে এসেছে।

পৌরাণিক কাহিনি: দেবীর আবির্ভাব: পুরাণে বলা হয়, মহিষাসুর নামের এক অসুর দেবতাদের ওপর চরম অত্যাচার শুরু করে। তার শক্তির কাছে একক কোনো দেবতা দাঁড়াতে পারেননি। তখন সব দেবতা নিজেদের শক্তি একত্রিত করে এক মহাশক্তির জন্ম দেন— দেবী দুর্গা। দশভূজা দুর্গা মহিষাসুরের সঙ্গে টানা নয় রাত যুদ্ধ করে তাকে বধ করেন। এই বিজয়ের স্মরণেই দুর্গাপূজা।

অসুরদের আসল পরিচয়: ‘অসুর’ শব্দটির আদি অর্থ ছিল "প্রাণশক্তি" বা "ঈশ্বরত্ব"। ঋগ্বেদের প্রথম দিকের স্তোত্রে দেবতা যেমন মিত্র, বরুণ, ইন্দ্র— সবাইকে কখনো কখনো ‘অসুর’ বলা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী কালে আর্য সমাজে ‘অসুর’ শব্দটি বদলে যায়। স্থানীয় যেসব জনগোষ্ঠী আর্যদের প্রভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তাদের অনেককে অসুর বলে আখ্যা দেওয়া হয়। অর্থাৎ, পৌরাণিক অসুর আসলে অনেকাংশে আদিবাসী, দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক জনগোষ্ঠীর প্রতীক।

মহিষাসুর: অনার্য জনগোষ্ঠীর প্রতীক: মহিষাসুরকে বলা হয় অর্ধেক মহিষ, অর্ধেক মানুষ। ইতিহাসবিদদের মতে, এটি প্রাচীন ভারতবর্ষের পশুপালক ও কৃষিজীবী সমাজের প্রতীক। মধ্য ভারত, বাংলার আদিবাসী অঞ্চল এবং দক্ষিণ ভারতের বহু জনগোষ্ঠী পশুপালনভিত্তিক ছিল। তাই মহিষাসুরের পরাজয়কে প্রতীকীভাবে দেখা যায় অনার্য জনগোষ্ঠীর ওপর আর্য আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হিসেবে।

আজও পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডের কিছু আদিবাসী গোষ্ঠী মহিষাসুরকে ‘শহীদ’ হিসেবে স্মরণ করে। "মহিষাসুর শহীদ দিবস" নামে আলাদা অনুষ্ঠান হয়। এটি প্রমাণ করে যে পৌরাণিক কাহিনির আড়ালে স্থানীয় সম্প্রদায়ের বাস্তব স্মৃতি ও ইতিহাস রয়ে গেছে।

দুর্গার আবির্ভাব: শক্তির সংহতির গল্প: দেবী দুর্গার জন্মকথা থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পাওয়া যায়। আর্য দেবতারা যখন মহিষাসুরের কাছে পরাজিত হচ্ছিলেন, তখন তারা একত্রিত হয়ে শক্তি গড়ে তোলেন। ইতিহাসবিদদের মতে, এটি ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক সংহতির প্রতীক। অর্থাৎ, আর্য সমাজ বিভিন্ন ভিন্ন ভিন্ন গোত্র থেকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অনার্য জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে— দেবীর আবির্ভাব সেই ঐক্যের প্রতিফলন।

গবেষকদের ব্যাখ্যা: ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার মনে করেন, পুরাণের অসুরদের অনেকেই বাস্তবে ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন জাতিগোষ্ঠী, যাদের সঙ্গে আর্যদের সংঘর্ষ হয়েছিল।

সমাজবিজ্ঞানী ধীর্জেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, মহিষাসুর বধ কাহিনি আসলে কৃষিভিত্তিক অনার্য সমাজ ও যাযাবর যোদ্ধা আর্য সমাজের দ্বন্দ্বের প্রতীক।

সমসাময়িক লেখকরা দেখিয়েছেন, দুর্গাপূজা শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়; এটি সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাহিনিও বটে।

ধর্মীয় ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা: হিন্দু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দুর্গাপূজা হলো মহাশক্তির জয়, অশুভের বিনাশ এবং শুভের প্রতিষ্ঠা। ভক্তদের কাছে এটি দেবী দুর্গার মাহাত্ম্য, শক্তি ও মাতৃত্বের প্রতীক। কিন্তু ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, এই কাহিনি এক ধরনের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগ্রামের প্রতিফলন, যেখানে আর্যদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অনার্যদের অসুর রূপে চিত্রিত করা হয়েছে।

উপসংহার : দুর্গাপূজা আজ এক গভীর ভক্তি ও আনন্দের উৎসব। কিন্তু এর আদি কাহিনি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ধর্মীয় পুরাণ প্রায়ই ইতিহাস ও সমাজবাস্তবতার সঙ্গে মিশে যায়। দেবতা–অসুরের যুদ্ধ কেবল আধ্যাত্মিক প্রতীক নয়, বরং সম্ভবত আর্য–অনার্য সংঘর্ষের প্রতিধ্বনি। এই দ্বৈত ব্যাখ্যাই দুর্গাপূজাকে শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনের এক অনন্য প্রতিচ্ছবি বানিয়েছে।

লেখক: হিরণ্ময় হিমাংশু, সম্পাদক, দৈনিক বর্তমান বাংলা 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ