‘শঙ্কা’ শব্দটির সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। শঙ্কার অর্থ ভয়, বিপদ, দুর্বলতা, ভীত ইত্যাদি। আজকাল সমাজের প্রতিটি মানুষ কেমন যেন শঙ্কার মধ্যে দিন পার করছেন। কিন্তু কেন? প্রশ্নটির উত্তর জানলেও অনেকে মনে লালন করছেন। রাস্তাঘাটে যাতায়াতের সময় মানুষের কথাবার্তা বা ইঙ্গিতেই এই শঙ্কার পরিবেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আপনি কি নিরাপদ বোধ করছেন?
সম্মানিত পাঠক,
আপনি ভাবছেন—মূল বিষয়টি কী? মূল বিষয়টি সব সময় আপনার মধ্যেই কাজ করছে, তথাপি আপনি শঙ্কাকে শঙ্কা ভেবে নীরবে দিন পার করছেন, মনের মধ্যে লালন করছেন কোনো প্রতিবাদ না করে। কী প্রতিবাদ করার আছে আপনার? নিশ্চয়ই ভাবছেন—‘কিছু একটা করা দরকার’। কিন্তু ঝামেলা এড়াতে একসময় আপনি নীরব হয়ে যান। হ্যাঁ, এই নীরবতাই এক ধরনের প্রতিবাদের ভাষা। অপেক্ষায় থাকুন—সময় বলে দেবে সমাধানের পথ।
প্রিয় পাঠক,
কোনো না কোনো কারণে আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারছেন না, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছেন না, বাকস্বাধীনতা প্রকাশ করতেও ভয় পাচ্ছেন। আবার, যদি এই স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করেন কোনো রাজনৈতিক দলের অসুস্থ নেতা, পাতিনেতা বা তেল মারা চামচা, তবে তো কথাই নেই—তার পেশিশক্তির কাছে আপনি তুচ্ছ বা অসহায়।
আপনি উচ্চশিক্ষিত, বংশীয়, ভদ্র? ঝুলিতে রাখুন আপনার সেই বিশেষণগুলো। রাজনীতিতে এসবের দরকার এককালে ছিল, এ যুগে নেই। এখন শুধু অর্থ, তেলবাজি আর মিথ্যার কৌশল রপ্ত করলেই কেল্লাফতে!
নেতা কে?
যিনি সঠিক নেতৃত্ব দেন। এমন সঠিক নেতৃত্বদাতা আজ খুবই কম। নগণ্য সংখ্যক থাকলেও তাঁরা সম্মান রক্ষায় আড়ালে থাকেন। স্বাধীনতাপূর্ব ও পরবর্তী নেতৃত্বের কথা মনে পড়লে আজও বুক ভরে যায়। স্কুল–কলেজগামী শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সাধারণ মানুষ, পথযাত্রী, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, অফিসগামী কর্মকর্তা, মা–বোন—সবাই কোনো না কোনোভাবে শঙ্কার মধ্যে বাস করছে। সমাজের শান্ত, নিরীহ মানুষদেরকে এই সমাজেরই এক শ্রেণির বিপথগামী মানুষ, অর্থলোভী রাজনীতিবিদেরা শঙ্কার পরিবেশ তৈরি করছে, যা শান্ত মানুষদের মনে–প্রাণে পীড়া দিয়ে সমাজকে অশান্ত করছে।
কে দায়ী এর জন্য?
নিশ্চয়ই অশান্ত রাজনীতি।
আর কে তৈরি করল এই অশান্ত রাজনীতি?
উত্তর—অসুস্থ রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
স্বার্থান্বেষী অসুস্থ নেতাদের দিয়ে রাজনীতি হয় না, মানুষের কল্যাণ হয় না, দেশ তাদের কাছ থেকে কিছুই আশা করতে পারে না। অসুস্থ নেতা নিজ স্বার্থ উদ্ধারে অর্থ গুছিয়ে কিছু অসুস্থ শিষ্য জড়ো করে দল ভারী করে, মোটর শোভাযাত্রা ও সমাবেশ দিয়ে সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। সে ভাবে—মানুষ তাকে গ্রহণ করছে! অথচ মানুষ চুপচাপ সহ্য করছে বাধ্য হয়ে।
গ্রামে-গঞ্জে মোড়ল হতে চায় সে, পছন্দের নেতার ছবির পাশে নিজের ছবি সেঁটে দেয়, যেন নিজেও নেতা বনে যায়। যতসব লজ্জাহীন, কুখ্যাত নিশাচর অসুস্থ নেতা তাদের আহ্বানে দল ভারী করে সমাজে অশান্তি ছড়ায়।
অবশেষে, স্বার্থের রাজনীতি খেয়ে–দেয়ে একদিন এই অসুস্থ নেতা ও পাতিনেতারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে—ভবিষ্যতেও হবে, শুধু সময়ের অপেক্ষা।
আর সেই অসুস্থ শিষ্যরা বোঝে না যে, রক্ষণশীল কুবুদ্ধিধারী নেতা, উপনেতা, ভারপ্রাপ্ত নেতা সবাই একে অপরকে ব্যবহার করছে বা ব্যবহৃত হচ্ছে। এদের কারণেই সমাজ দূষিত হচ্ছে, স্বাভাবিক কাজ–কর্ম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, এবং সমাজে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
এই পাতিনেতারা সমাজে আতঙ্ক ছড়িয়ে নোংরামি করছে। এদের প্রতিহত করতে রাষ্ট্রযন্ত্রের সক্রিয় ভূমিকা জরুরি হয়ে পড়েছে। তাদের আষ্ফালনে সমাজ আজ পীড়াগ্রস্ত, যেন কান্ডারিহীন জাহাজের মতো অজানা গন্তব্যে নিমজ্জিত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
রাষ্ট্রযন্ত্রসহ সমাজের সচেতন শুভজনের ঘুম ভাঙা এখন সময়ের দাবি। একজন আদর্শ নেতার গুণাবলি আদর্শ দিয়েই গড়া। আজ কিংবা অতীতে যারা নিজেদের দলীয় আদর্শ নিয়ে লাফালাফি করেছে, তাদের মধ্যে কি দেশপ্রেমের কোনো চিহ্ন আছে? তারা শুধু মুখোশ পরে মিষ্টি কথা বলে জনতাকে ঠকায়। মানুষের হৃদয়-মন্দিরে স্থান নেওয়ার মতো নেতৃত্ব আজ আমাদের খুবই প্রয়োজন।
আজকাল একান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ কোনো নেতার কাছে যেতে চায় না, কারণ সে জানে—সেখানে গেলে সম্মান রক্ষার ঝুঁকি আছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার পেশিশক্তিধারীরা নেতাকে ঘিরে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত। আর নেতা জানেন—দল ভারী করতে তেলবাজ লোক দরকার, কারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কেউ তার কাছে আসে না।
দেশ গঠনে যুগে যুগে সকলের অবদান আছে, যা অস্বীকার করা যায় না। এ. কে. ফজলুল হক, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী—এরকম গুণী নেতৃত্বের কারণেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। তাঁরা মানুষের অধিকারের উৎস তৈরি করে উপহার দিয়েছিলেন, কিন্তু এখন সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে নানা কৌশলে।
তাঁদের অস্বীকার করা মানেই মুক্তিযুদ্ধকে মুছে ফেলা। মুক্তিযুদ্ধে ১১টি সেক্টরের দায়িত্বে থাকা সূর্যসন্তান কমান্ডাররা জীবন বাজি রেখে দেশ মুক্ত করেছিলেন। আজ তাঁদের সম্মান নিয়েও টানাহেঁচড়া চলছে। লজ্জার শেষ কোথায়!
যারা দেশের স্বাধীনতা দেখেনি কিংবা তখন জন্মায়নি, তারা কি আর বোঝে মুক্তিযুদ্ধের রক্তঝরা ইতিহাস কী ছিল? শিশু চোখে যতটুকু দেখেছি—জীবন বাঁচাতে হোগলাপাতার বিলে ছিপ নৌকায় অনাহারে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি, মনে হয়েছে এই বুঝি পাকসেনারা ধরে নিয়ে যাবে। যা ভুক্তভোগী না হলে বোঝা অসম্ভব।
সাজানো সংসারে মাতব্বরি করা খুব সহজ, কিন্তু সত্যিকার নেতৃত্ব দেওয়া কঠিন। কিছু নেতার আচরণ দেখে অবাক হতে হয়—তারা ভাবে অবৈধ ক্ষমতা চর্চা করলেই মানুষ তাদের যোগ্য নেতা মনে করবে! বাস্তবে তা নয়। অনেকে কৌশলে সমাজে মনস্তাত্ত্বিক আতঙ্ক সৃষ্টি করে ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। এদেরই বলে সাইকোলজিক্যাল টেররিস্ট বা মনস্তাত্ত্বিক সন্ত্রাসী।
এই সমাজের বড় বিচারক সাধারণ মানুষ। সুযোগ পেলে তারা নেতৃত্ব মূল্যায়ন করতে জানে। কিন্তু স্বার্থান্বেষী অর্থলোভী অসুস্থ নেতৃত্বের কারণে আজ সমাজ শঙ্কাগ্রস্ত।
‘মিথ্যা বলা মহাপাপ’—এই ধ্রুব সত্যটি আজ বিলুপ্তির পথে।
সাধারণ, সুশীল মানুষ সতর্ক হোন!
যেখানেই অন্যায়, সেখানেই প্রতিবাদ—এই নীতিই পারে সমাজকে শঙ্কামুক্ত করতে।
অসুস্থ নেতৃত্বের কারণেই মানুষ এখন প্রতিবাদ করার সাহস পায় না।
অতএব, আমাদের সুস্থ নেতৃত্বের পদাঙ্ক অনুসরণ করতেই হবে।
লেখক:
শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক,
মঠবাড়িয়া প্রেসক্লাব, পিরোজপুর
মোঃ রোকনুজ্জামান শরীফ মেইল

