সম্প্রতি সৌদি আরব ও পাকিস্তানের মধ্যে হওয়া প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। ‘স্ট্র্যাটেজিক মিউচুয়াল ডিফেন্স এগ্রিমেন্ট’ শিরোনামে ঘোষিত এই চুক্তি অনুযায়ী, যে কোনো এক দেশের বিরুদ্ধে আক্রমণকে অপর দেশের বিরুদ্ধে আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। চুক্তির পূর্ণাঙ্গ পাঠ এখনো প্রকাশিত হয়নি, তবে এতটুকুই যথেষ্ট আলোড়ন তোলার জন্য।
অস্পষ্ট বার্তা ও পারমাণবিক প্রশ্ন
পাকিস্তান তাদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতার অংশ হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রথমে বললেও যে এ বিষয়ে কিছু নেই, পরদিনই জিও টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, প্রয়োজনে পাকিস্তানের পারমাণবিক সক্ষমতা এ চুক্তির আওতায় আসতে পারে। ইতিহাস বলছে, সৌদি আরব অতীতে পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে অর্থায়ন করেছে, এমনকি সৌদি প্রিন্স সুলতান পাকিস্তানের গোপন পরমাণু স্থাপনা পরিদর্শনও করেছিলেন। তবে প্রকৃত অর্থে সৌদি আরবের পারমাণবিক প্রতিরক্ষা ছাতা কতটা কার্যকর, তা এখনও অস্পষ্ট।
পুরোনো খেলার নতুন মোড়
১৯৮০–র দশকে সৌদি আরব চীন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র কিনেছিল, যেগুলো মূলত পারমাণবিক অস্ত্র বহনের জন্য উপযোগী হলেও ব্যবহার হয়নি। তখনও টার্গেট ছিল ইসরায়েল নয়, বরং ইরান। বর্তমান ঘোষণাতেও একই সংকেত দেখা যাচ্ছে। তবে বিস্ময়কর হলো, ইরান এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। তাদের ভাষ্যমতে, এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার সূচনা। কিন্তু পাকিস্তানের জন্য এটি আরও জটিল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, কারণ সুন্নি–শিয়া বিভাজনের ভেতর পারমাণবিক ছাতা কতটা কার্যকর, তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন থেকেই যায়।
পাকিস্তানের সামর্থ্য ও সীমাবদ্ধতা
পাকিস্তানের হাতে প্রায় ১৭০টি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, ভারতের সংখ্যার সঙ্গে প্রায় সমান। কিন্তু এগুলোর বড় অংশই চীনা প্রযুক্তি ও সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। ফলে সৌদি আরব চাইলে পাকিস্তানি ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করাও চীনের অনুমোদন ছাড়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল সামরিক চুক্তি ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে সৌদি আরবে। তাই ওয়াশিংটনের সম্মতি ছাড়া বেইজিং–ইসলামাবাদ অক্ষ বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ
ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক ভূমিকায় বোঝা যায়, ওয়াশিংটন চাইছে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের সরাসরি সম্পৃক্ততা কমিয়ে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর কাঁধে বোঝা চাপাতে। ইউক্রেন ইস্যুতে ইউরোপকে যেমন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তেমনি সৌদি–পাকিস্তান জোটের মাধ্যমে ইরান–আফগানিস্তান ইস্যুতে চাপ কমাতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে এটি ভারতের প্রতিও এক ধরনের কূটনৈতিক বার্তা—দিল্লিকে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াতে বাধ্য করার ইঙ্গিত।
উপসংহার
চুক্তিটি কার্যকর হলে এর প্রভাব পড়বে শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়, ভারত, চীন ও রাশিয়াতেও। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সামরিক বাস্তবতা, সৌদি আরবের আঞ্চলিক অবস্থান, চীনের কৌশলগত স্বার্থ ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক লক্ষ্য—সব মিলিয়ে এটি এক জটিল ভূরাজনৈতিক সমীকরণ। তবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, পাকিস্তানি গণমাধ্যমের প্রচারিত আত্মতুষ্টি—যে, ভারতের ওপর তথাকথিত ‘বিজয়’ পাকিস্তানকে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়েছে। বাস্তবতা স্বীকার না করে যদি কৌশল নির্ধারণ করা হয়, তবে সেই কৌশল শুরুতেই ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
তারা কার্থা- ভারতীয় নিরাপত্তা পরিষদ সচিবালয়ে সাবেক কর্মকর্তা, সূত্রে:এনডিটিভি

