ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র হলো ভোটাধিকার। কিন্তু নাগরিকত্ব যাচাই, অবৈধ অভিবাসন ও আধারের মতো পরিচয়পত্রের বৈধতা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিহারের বিশেষ নিবিড় সংশোধনী (SIR) প্রক্রিয়ায় আধার কার্ডকে ভোটার পরিচয়ের প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করার কথা বলা হয়। নির্বাচন কমিশন (ইসিআই) তাতে আপত্তি জানালেও আদালত স্পষ্ট করেছে—আধার পরিচয়ের প্রমাণ হতে পারে, তবে নাগরিকত্বের চূড়ান্ত প্রমাণ নয়।
পরিচয় বনাম নাগরিকত্ব
এখানেই মূল সংকট। আধার মূলত সামাজিক সুরক্ষা ও সরকারি সেবায় সুবিধা পৌঁছাতে তৈরি। কিন্তু তা নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা দেয় না। সংবিধানের ৩২৬ অনুচ্ছেদ বলছে, কেবলমাত্র ভারতীয় নাগরিকেরাই ভোট দিতে পারবেন। একইভাবে, ২০১৮ সালের কেএস পুট্টাস্বামী মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল—আধার নাগরিকত্ব প্রমাণের নথি নয়। ফলে ভোটাধিকার ও আধার সংযুক্তির প্রশ্ন নতুন দ্বন্দ্ব তৈরি করছে।
উত্তর-পূর্ব ভারতে শঙ্কা
অবৈধ অভিবাসন ইস্যুতে আসাম বরাবরই আলোচনার কেন্দ্র। আসাম আন্দোলন (১৯৭৯-৮৫) নাগরিকত্ব আইনে পরিবর্তন আনে। নাগরিকত্ব আইনের ১৯৮৬ সালের সংশোধনে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পেতে অন্তত একজন অভিভাবককে ভারতীয় হতে হয়। এভাবেই ভারত ধীরে ধীরে jus soli (জন্মসূত্রে অধিকার) থেকে jus sanguinis (রক্তসূত্রে অধিকার)-এর দিকে ঝুঁকে যায়।
আজও এই বিতর্ক জিইয়ে আছে। আসামের চার জেলায়—বারপেটা, ধুবরি, মরিগাঁও ও নগাঁও—আধার কার্ডধারীর সংখ্যা অনুমিত জনসংখ্যার চেয়েও ১০৩% বেশি। রাজ্য সরকার নিরাপত্তার স্বার্থে নতুন আধার প্রদান বন্ধ করেছে।
পশ্চিমবঙ্গেও উদ্বেগ
পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতেও একই চিত্র। রাজ্যের প্রধান নির্বাচনী দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, নতুন ভোটার তালিকায় ১০.০৪ লাখ আবেদন জমা পড়লেও ২.৪৩ লাখ বাতিল হয়েছে। এর বড় অংশ এসেছে সীমান্তবর্তী জেলা—মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মালদহ ও নদিয়া থেকে। এতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে আশঙ্কা বাড়ছে যে, অবৈধ অভিবাসীরা ভোটার তালিকায় ঢুকে পড়ছে।
আইন ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব
ভারতের দুটি প্রধান আইন নাগরিকত্ব ইস্যু নিয়ন্ত্রণ করে—ফরেনার্স অ্যাক্ট, ১৯৪৬ ও সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট, ১৯৫৫। একটিতে “বিদেশি”কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, অন্যটিতে “অবৈধ অভিবাসী”কে। আসামে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হয়—প্রমাণস্বরূপ প্রাক-১৯৭১ সালের ভোটার তালিকা, জমির দলিল বা পারিবারিক উপস্থিতি। এই প্রেক্ষাপটে আধারকে পরিচয়পত্র হিসেবে ভোট প্রক্রিয়ায় যুক্ত করলে আইনি জটিলতা আরও বাড়বে।
জাতীয় নিরাপত্তা বনাম গণতন্ত্র
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, আদালতের নির্দেশনা সাধারণ মনে হলেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ভোটাধিকার নাগরিকত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত, অথচ আধার নাগরিকত্ব প্রমাণ করে না। সীমান্তবর্তী আসাম, পশ্চিমবঙ্গ বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এটি জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে পরিণত হচ্ছে।
অমীমাংসিত প্রশ্ন
– ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়া কি কারও ‘অ-নাগরিক’ পরিচয়ের প্রমাণ হতে পারে?
– আধার যদি নাগরিকত্বের প্রমাণ না হয়, তবে ভোট প্রক্রিয়ায় তা কতটা যুক্তিযুক্ত?
– সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে অবৈধ অভিবাসন রোধে কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ উদ্যোগ কতটা কার্যকর?
উপসংহার
ভারতের গণতন্ত্রে ভোটাধিকার একটি মৌলিক অধিকার। কিন্তু নাগরিকত্ব ও পরিচয়ের এই দ্বন্দ্বে দেশের সাংবিধানিক কাঠামো নতুন পরীক্ষার মুখে। আধারকে পরিচয়ের প্রমাণ হিসেবে ভোটে ব্যবহার করা হলে তা কি নাগরিকত্বের সংকটকে গভীর করবে, নাকি সুষ্ঠু ভোট প্রক্রিয়ার জন্য সহায়ক হবে—এই প্রশ্ন এখন সারা দেশের সামনে।
লেখক: স্বপন দাশগুপ্ত ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের একজন বিশিষ্ট ফেলো। অর্পণ এ চক্রবর্তী নয়াদিল্লির ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের একজন গবেষণা ফেলো। সূত্র-এনডিটিভি

