বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের ইতিহাস এক দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফসল। এই রাষ্ট্রযন্ত্র কখনো গণতান্ত্রিক শাসনের হাতিয়ার, আবার কখনো স্বৈরাচারের সেবক হয়ে উঠেছে। ২০২৫ সালের অন্তর্বর্তী সরকারের সময় আবারও প্রশ্ন জেগেছে—রাষ্ট্রযন্ত্র আসলে কার স্বার্থে কাজ করছে? জনগণের, না ক্ষমতার?
রাষ্ট্রযন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য হলো নাগরিকের জীবন, সম্পদ ও স্বাধীনতা রক্ষা করা। কিন্তু বাস্তব চিত্রটি যেন তার উল্টো। প্রশাসনের বড় অংশ আজও রাজনৈতিক আনুগত্যে পরিচালিত। মাঠপর্যায়ের আমলা থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারক—অনেকে যেন ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর রক্ষাকবচে পরিণত হয়েছেন। ফলে আইন হয়ে উঠছে একপেশে, ন্যায়বিচার সীমাবদ্ধ কাগজে, আর নাগরিক অধিকার হারিয়ে যাচ্ছে ভয় ও অনিশ্চয়তার জালে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়টি ছিল জাতির জন্য পুনর্গঠনের সুযোগ। কিন্তু দেখা গেল—মব সংস্কৃতি, প্রভাব ও ক্ষমতার দাপট রাষ্ট্রযন্ত্রকে আবারও দখল করে ফেলেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে দমননীতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে নজরদারি, আর গণমাধ্যমের ওপর নিপীড়ন—এসব এখন রাষ্ট্রযন্ত্রের নিত্যচিত্র। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সরকারি আমলা, সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী—এমনকি মুক্তিযোদ্ধারাও এই যন্ত্রের অন্যায়ের শিকার হয়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রযন্ত্রকে আর নিজের রক্ষাকবচ মনে করে না; বরং ভয় পায়। কারণ, যখন প্রশাসনের নিরপেক্ষতা হারিয়ে যায়, তখন গণতন্ত্রের ভিত নড়বড়ে হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রযন্ত্র তখন আর নাগরিকের সেবক নয়—বরং নাগরিকের শাসক হয়ে ওঠে।
তবে আশার কথা—প্রতিটি দুঃসময়ের ভেতরেই নতুন সম্ভাবনার জন্ম হয়। রাষ্ট্রযন্ত্রকে জনগণের নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনতে হলে প্রয়োজন জবাবদিহিমূলক প্রশাসন, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, এবং নির্ভীক গণমাধ্যম। সরকার পরিবর্তন নয়—মানসিকতার পরিবর্তনই পারে রাষ্ট্রকে মুক্তির পথে নিয়ে যেতে।
অন্তর্বর্তী সরকারের এই সময়কাল ইতিহাসে হয়তো এক পরীক্ষার সময় হিসেবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু যদি আমরা এই সময়ের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিতে পারি, তবেই নাগরিক স্বাধীনতা ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার নতুন ভিত্তি গড়ে তোলা সম্ভব।
রাষ্ট্রযন্ত্র জনগণের—জনগণের জন্য—এটাই হোক আগামী বাংলাদেশের প্রতিজ্ঞা।
লেখক:
শিক্ষক ও সাংবাদিক
সাধারণ সম্পাদক, মঠবাড়িয়া প্রেসক্লাব, পিরোজপুর
sharifsstyle@gmail.com

