logo
ads

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হোক, অস্থিরতা নয়

হিরণ্ময় হিমাংশু

প্রকাশকাল: ১২ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৩৬ এ.এম
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হোক, অস্থিরতা নয়

প্রতিকী ছবি

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিরোধী মতের লোকদের গুম ও নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের দুই মামলায় প্রসিকিউশনের দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়ে গত বুধবার ৩০ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সেনাবাহিনীর ওই কর্মকর্তাদের গ্রেফতার এবং তাদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবির মধ্যে শনিবার (১১ অক্টোবর) সেনা সদরে এক সংবাদ সম্মেলনে ১৫ জনকে হেফাজতে নেওয়ার কথা জানায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে 'আরও শতাধিক সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির' খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পরলে সেটিকে ‘সম্পূর্ণ বানোয়াট ও গুজব’ বলে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম শনিবার রাতেই ফেইসবুক পোস্টে লেখেন, "আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আরও শত শত সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে যাচ্ছে বলে ভিত্তিহীন গুজব ছড়ানো হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটরের কার্যালয় থেকে আমাদের জানানো হয়েছে যে, বর্তমানে সশস্ত্র বাহিনীর আর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করার কোনও পরিকল্পনা নেই।” উল্লেখ করে জনসাধারণকে এই ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্যে বিশ্বাস না করার আহ্বান জানান শফিকুল আলম। 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক জীবনে নতুন এক অধ্যায় সূচিত হয়েছে আন্তর্জাতিক আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানার ভিত্তিতে সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তাকে হেফাজতে নেওয়ার মধ্য দিয়ে। ঘটনাটি যেমন নজিরবিহীন, তেমনি তা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে আইন ও ন্যায়বিচারের অগ্রযাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হতে পারে, তবে এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি ও ফলাফলই নির্ধারণ করবে, এটি কি দায়বদ্ধতার সূচনা না নতুন অস্থিরতার কারণ হবে।

বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্তি কামনা করছে। গুম, বেআইনি আটক, ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বহু বছর ধরে ক্ষোভ জমেছে সাধারণ মানুষের মনে। আন্তর্জাতিক আদালতের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ তাই অনেকের কাছে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশিত প্রতিফলন। কিন্তু এই প্রক্রিয়া যেন ন্যায় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতাকেও সুরক্ষিত রাখে, সেটিই এখন সবচেয়ে জরুরি।

সেনাবাহিনী একটি জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। তাদের সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও নিরপেক্ষতা প্রয়োজন। কারণ, সেনাবাহিনীর ভেতরে বিভাজন বা আস্থাহীনতা সৃষ্টি হলে তা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামোর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। আইনের প্রয়োগ যেন কোনোভাবেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়, সেটি নিশ্চিত করা রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগের নৈতিক দায়িত্ব।

একইসঙ্গে, সরকারকেও মনে রাখতে হবে—ন্যায়বিচার তখনই জনগণের আস্থা অর্জন করে, যখন তা স্বচ্ছ, স্বাধীন ও পক্ষপাতহীনভাবে পরিচালিত হয়। আইন ও ন্যায়বিচারের নামে যদি রাজনৈতিক প্রতিশোধ বা প্রভাব খাটানোর আশঙ্কা দেখা দেয়, তাহলে তা গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের ভিত্তি দুর্বল করবে। অন্যদিকে, যদি এই পদক্ষেপ প্রকৃত ন্যায় ও মানবাধিকারের প্রতিফলন হয়ে ওঠে, তাহলে সেটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রাপথে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে স্মরণীয় থাকবে।

আজ প্রয়োজন সতর্কতা, সংযম ও দায়বদ্ধতা। বিচার প্রক্রিয়া যেন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ও পেশাদারিত্ব অক্ষুণ্ণ রেখে এগিয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা বজায় রাখতে হবে, যাতে কোনো অপপ্রচার বা বিভ্রান্তি জাতীয় ঐক্যকে ক্ষুণ্ণ না করে।

বাংলাদেশ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে প্রতিটি সিদ্ধান্তই ভবিষ্যতের স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলবে। এই মুহূর্তে দায়িত্বশীলতা, ন্যায়নিষ্ঠা ও রাষ্ট্রচেতনার পরীক্ষায় সবাইকে উত্তীর্ণ হতে হবে। আইন যেন প্রতিশোধের নয়, ন্যায়ের হাতিয়ার হয়—এটাই এখন সময়ের সর্বাধিক প্রয়োজনীয় আহ্বান।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ