রাঙামাটির এক কর্মচঞ্চল কার্যালয়ে সারি সারি সেলফে রাখা সাদা তুলোর মতো স্তূপ। তবে এগুলো তুলো নয়—এগুলো কলাগাছ থেকে পাওয়া আঁশ। সেগুলো থেকেই তৈরি হচ্ছে নারীদের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসুরক্ষার পণ্য ‘প্রকৃতি’ স্যানিটারি ন্যাপকিন।
নারীর স্বাস্থ্য, পরিবেশবান্ধব উদ্ভাবন আর স্থানীয় সম্পদের সৃজনশীল ব্যবহারের এক অনন্য উদ্যোগ এটি। নেতৃত্বে আছেন পাহাড়ি নারী উন্নয়নকর্মী নাইউ প্রু মারমা মেরী।
ভারতের আহমেদাবাদ থেকে রাঙামাটির পাহাড়ে
মেরী জানান, উন্নয়নকাজে পৃথিবীর নানা দেশে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁর। কিন্তু ভারতের আহমেদাবাদে গিয়ে যখন দেখলেন স্থানীয় নারীরা কলাগাছের আঁশ দিয়ে পুনর্ব্যবহারযোগ্য ন্যাপকিন তৈরি করছে, তখনই তাঁর মনে হলো—“এটি রাঙামাটিতেও সম্ভব।”
ফিরে এসে উইভ (উইমেন্স এডুকেশন ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট) নামের নিজের সংস্থাকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সহযোগিতায় এগিয়ে আসে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা আরএসএফ সোশ্যাল ফাইন্যান্স।
কাজের ঘরে ব্যস্ত নারীরা
উইভ কার্যালয়ে ঢুকলেই চোখে পড়ে কয়েকজন নারী কর্মী সেলাই মেশিনে মনোযোগ দিয়ে ন্যাপকিন তৈরি করছেন। এক কোণে শুকোতে দেওয়া আঁশ, অন্য কোণে ইউভি মেশিনে জীবাণুমুক্তকরণের কাজ চলছে।
কর্মীরা জানান, প্রথমে কলাগাছ থেকে আঁশ সংগ্রহ করা হয়। এরপর প্লেটের সাহায্যে কটন স্তর তৈরি করা হয়। শুকানো শেষে সেই স্তরকে কাপড়ের সঙ্গে সেলাই করে তৈরি হয় ন্যাপকিন। শেষে প্যাকেটে ভরে বাজারজাতের জন্য প্রস্তুত করা হয়। প্রতিটি প্যাকেটে থাকে ৮টি পুনর্ব্যবহারযোগ্য ন্যাপকিন।
নারীদের জন্য উপহার, পরিবেশের জন্য স্বস্তি
প্রকৃতি ন্যাপকিন শুধু স্বাস্থ্যসম্মত নয়, বরং পরিবেশবান্ধবও। একবার ব্যবহার করে ফেলে দিতে হয় এমন প্লাস্টিক-নির্ভর ন্যাপকিনের বিকল্প হিসেবে এটি মাটিতে সহজে নষ্ট হয় এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য।
মেরীর ভাষায়— “আমরা চাইছি নারীরা যেন স্বাস্থ্যসম্মত বিকল্প পান, আবার একই সঙ্গে পরিবেশও রক্ষা পায়। প্রাথমিকভাবে পাঁচ হাজার নারী ও কিশোরীকে বিনামূল্যে ন্যাপকিন দেওয়া হচ্ছে।”
অপেক্ষা শুধু অনুমোদনের
প্রকৃতি ন্যাপকিনের জন্য ইতোমধ্যেই বিএসটিআই অনুমোদনের আবেদন করা হয়েছে। অনুমোদন পেলে বাজারজাত শুরু হবে। দামও রাখা হবে যাতে পাহাড়ের প্রান্তিক নারীরা সহজে কিনতে পারেন।
সমাজে ইতিবাচক প্রভাব
এই উদ্যোগ শুধু নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াবে না, বরং কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করবে। স্থানীয় নারীরা সরাসরি ন্যাপকিন তৈরির কাজে যুক্ত হয়ে আয় করছেন।
রাঙামাটির এই উদ্ভাবন হয়তো একদিন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। আর সেটিই হবে সত্যিকারের পরিবর্তন— “নারীর স্বাস্থ্য রক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ আর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন—একসাথে।”

