শরতের সকালে কিশোরগঞ্জের ধানখেতের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন আবু কালাম। হাতে এক মুঠো মাটি, চোখে একটা দূরের আলো। গত বছরের লোকসানের ক্ষত এখনো তাজা—হিমাগারে রাখা আলু কেজি মাত্র ১১ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কিন্তু আজ তিনি আবার রোপণ করছেন, আগাম 'সেভেন' জাতের বীজ মাটিতে গেঁথে। "ঝুঁকি না নিয়ে কী হবে? ভালো হলে দ্বিগুণ লাভ, না হলে আবার শুরু," বলে হাসেন তিনি। এই গল্প শুধু কৃষকের নয়, উদ্যোক্তাদের জন্য একটা আশাজাগানো বার্তা—যেখানে চ্যালেঞ্জের মাঝে লুকিয়ে থাকে সাফল্যের সুযোগ।
আগাম মৌসুমের রোপণ: স্বপ্নের প্রথম পদক্ষেপ
শরতের হাওয়ায় শীতের আমেজ মিশে যাচ্ছে, কিন্তু দিনের তাপে মাটি গরম। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায়, যা আগাম আলুর জন্য দেশজুড়ে পরিচিত, চাষিরা আউশ-আমন ধান কাটার পর সেই জমিতেই হাত বাগিয়ে নিয়েছেন। জমি চাষ, সার মেশানো, হিমাগার থেকে বীজ নিয়ে রোপণ—সব চলছে জোরকদমে। 'সেভেন' জাতের আলু, যা মাত্র ৫০-৬০ দিনে ফলন দেয়, বাজারে চাহিদা ও দামের দুই রাজা। কৃষক মোক্তার হোসেন বলেন, "চার বিঘা জমিতে লাগালাম। আগাম তোলা হলে ঢাকা-চট্টগ্রামের পাইকাররা ট্রাক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। গতবারের মতো লোকসান হবে না, এবার লাভের আলো দেখছি।"
জেলার কৃষি অফিসের তথ্য বলছে, এবার রংপুর অঞ্চলে আলু চাষের টার্গেট ১ লক্ষ হেক্টর ছাড়িয়ে গেছে—প্রায় ১.১৮ লক্ষ হেক্টরে রোপণ হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, "জানুয়ারি পর্যন্ত চাষ চলবে। ফলন বাম্পার হলে কৃষকদের পকেট ভরবে। সরকারি সহায়তা—জিরো সুদে লোন, বীজ সরবরাহ—এসব তাদের পাশে আছে।"
জলবায়ুর ছায়া: চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি লড়াই
আলু শীতপ্রধান ফসল, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের এই যুগে শরতে দিনের তীব্র গরমে বীজ নষ্ট হওয়ার ভয়। অকাল বৃষ্টি পড়লে ফসল ধ্বংস, নতুন করে রোপণ—যা আগাম জাতকে সাধারণ ভ্যারাইটিতে পরিণত করে দেয়। ফলে বাজারে দাম পড়ে যায়। সেলিম রেজা, যার নামেই এই গল্প শুরু, বলেন, "৮ বিঘা জমিতে বিনা-৭ জাত লাগিয়েছি। খরচ বিঘায় ২০-২২ হাজার টাকা, কিন্তু ভালো হলে ৫০-৭০ হাজার লাভ। গত বছর হিমাগারে আলু ১১-১২ টাকায় গেল, উৎপাদন খরচ ৩০ টাকা ছিল। বীজ ১৩-২০ টাকায় কিনি, কিন্তু অন্য সবজির দাম চড়লেও আলুর দাম আটকে। তবু, আশা ছাড়ি না—এটা আমাদের জীবনের লড়াই।"
স্থানীয় লাইভ মিউজিয়ামে (ডোমার ফাউন্ডেশন সীড ফার্ম) চলছে ৯০টির বেশি আলু জাতের প্রদর্শনী। এখানে কৃষকরা নতুন জাত যেমন হিরা-২, ব্রি-৩৩ শিখছেন, যা জলবায়ু-সহনশীল। এটা কৃষকদের উদ্যোক্তামন্ত্র—নেটওয়ার্কিং করে জ্ঞান অর্জন, চ্যালেঞ্জকে সুযোগে রূপান্তর। বর্তমানে নতুন আলুর বাজার দাম ৪০-৬৫ টাকা কেজি, যা চাষীদের আশা জাগাচ্ছে।
উদ্যোক্তাদের জন্য অনুপ্রেরণা: ঝুঁকি থেকে জয়ের পথ
এই গল্প নীলফামারীর মাটি থেকে উঠে এসেছে, কিন্তু এর বার্তা সর্বত্র—বিশেষ করে উদ্যোক্তাদের জন্য। যেমন আপনারা ব্যবসায় ঝুঁকি নিয়ে নতুন পথ খুঁজছেন, ঠিক তেমনি এই চাষিরা কম পুঁজিতে 'আর্লি বার্ড' সুবিধা নিয়ে বাজারের গ্যাপ পূরণ করছেন। গত বছরের লোকসান ভুলে তারা এগোচ্ছেন, কারণ জানেন: সাফল্যের পথে বাধা আসবেই, কিন্তু আশা না ছাড়লে জয় হয়। এবার রেকর্ড উৎপাদন হলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি আসবে, আর কৃষকরা উদ্যোক্তার মতো লাভের স্বাদ পাবেন।
সংবাদকর্মী সেলিম রেজার মতো বলি: স্বপ্ন দেখুন, ঝুঁকি নিন, লড়াই করুন—আপনার যাত্রাও এমনই উজ্জ্বল হোক। নীলফামারীর এই আলু চাষীরা দেখাচ্ছেন, মাটির মতোই জীবন উর্বর—শুধু বীজ বপন করলেই ফল আসবে। আপনার গল্প কী? শেয়ার করুন!

