গাজীপুরের রাস্তায় বারবার একই দৃশ্য। সকালবেলা কাজের পোশাক পরে কারখানায় আসা শত শত নারী-পুরুষ হঠাৎ স্লোগান দিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ছেন। ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কারণ—বেতন পাওয়া যাচ্ছে না সময়মতো।
আলিফ ক্যাজুয়াল লিমিটেডের শ্রমিকরা সম্প্রতি এমনই এক ঘটনায় দেড় ঘণ্টা ধরে মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। তাদের অভিযোগ, জুলাই ও আগস্ট মাসের বেতন পরিশোধ করা হয়নি। সেপ্টেম্বর চলে এলেও কর্তৃপক্ষ নানা অজুহাতে টাকা দিতে টালবাহানা করছে।
এক নারী শ্রমিকের কণ্ঠে শোনা গেল অসহায়তা—
“বাড়িওয়ালা ভাড়া চাইছে, দোকানদার খাতায় মাল দিতে চাইছে না। অথচ আমরা নিজেরাই টাকা পাই না। সন্তানদের স্কুল ফি, চিকিৎসার খরচ—সবকিছুতেই অচলাবস্থা।”
এই চিত্র শুধু আলিফ ক্যাজুয়াল লিমিটেডের নয়। গাজীপুরের ভোগড়া, টঙ্গী, কাশিমপুর—প্রায় সব এলাকায় একই সংকট। কারখানা কর্তৃপক্ষ কখনও হঠাৎ ছুটি ঘোষণা করে, কখনও ভবিষ্যতে বেতন দেওয়ার আশ্বাস দেয়। কিন্তু সময়মতো টাকা মেলে না। ফলে শ্রমিকদের নেমে আসতে হয় রাস্তায়।
মানবিক সংকট
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে শ্রমিকরা মাসিক বেতনের ওপর নির্ভরশীল। এটাই তাদের একমাত্র আয়ের উৎস। তাই এক মাস বেতন আটকে গেলে পুরো পরিবার বিপদে পড়ে।
বাসাভাড়া বাকি পড়ে যায়, বাড়িওয়ালাদের চাপ বাড়ে।
দোকানপাট বাকি দিতে চায় না, ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার করাও কঠিন হয়ে যায়।
সন্তানদের স্কুল–কলেজের ফি বাকি পড়ে, শিক্ষাজীবন ঝুঁকির মুখে পড়ে।
ঋণ শোধ করা তো দূরের কথা, নতুন করে ধার করতে হয়, তাতেও সুদের বোঝা বাড়ে।
এক শ্রমিক বলেন,
“আমরা শুধু বেতনের টাকার দিকে তাকিয়ে থাকি। সেটা না পেলে বেঁচে থাকাটাই দায় হয়ে যায়।”
শিল্প খাতের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের রপ্তানির মূল ভরকেন্দ্র হলো তৈরি পোশাক খাত। অথচ সেই খাতেই বেতন–ভাতা নিয়ে প্রায়শই অস্থিরতা দেখা দেয়। এর পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে:
মালিকপক্ষের আর্থিক সংকট: বৈশ্বিক মন্দা, অর্ডার কমে যাওয়া বা ক্রেতাদের বিলম্বে অর্থ প্রদান মালিকদের তারল্য সংকটে ফেলে।
অব্যবস্থাপনা: শ্রমিকদের সঙ্গে সময়মতো তথ্য ভাগ না করা, ছুটি ঘোষণা করে সমস্যা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা ইত্যাদি ক্ষোভ আরও বাড়ায়।
আইন প্রয়োগের দুর্বলতা: শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের সময়মতো মজুরি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও অনেক প্রতিষ্ঠান তা মানে না। কার্যকর নজরদারি ও শাস্তির ব্যবস্থা নেই।
সংলাপের অভাব: শ্রমিক–মালিক–সরকারের মধ্যে সুস্থ আলোচনার অভাবে শ্রমিকরা সরাসরি রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়।
ভুক্তভোগী কেবল শ্রমিক নয়
প্রতিবার শ্রমিকরা রাস্তায় নামলে সাধারণ যাত্রীরাও ভোগান্তিতে পড়েন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট লেগে থাকে। এম্বুলেন্স আটকে যায়, অফিস–আদালতে গন্তব্যে পৌঁছাতে দেরি হয়। ফলে শ্রমিক–মালিক দ্বন্দ্বের প্রভাব সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
করণীয়
শ্রমিকদের বকেয়া বেতন ইস্যুতে বারবার মহাসড়ক অবরোধ প্রমাণ করছে সমস্যাটি শুধু একটি কারখানার নয়, বরং পুরো শিল্প খাতের একটি কাঠামোগত সংকট।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত নজরদারি ও জরিমানার ব্যবস্থা বাড়াতে হবে।
বেতন প্রদানে ডিজিটাল স্বচ্ছতা আনা জরুরি।
ক্রেতাদের কাছ থেকেও সময়মতো অর্থপ্রদানের নিশ্চয়তা চাই।
শ্রমিক কল্যাণ তহবিল আরও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে জরুরি মুহূর্তে শ্রমিকরা সহায়তা পান।
গাজীপুরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক শ্রমিক শেষ কথায় বললেন,
“আমরা সস্তায় কাপড় বানাই সারা দুনিয়ার জন্য। কিন্তু নিজেদের বেতনের টাকা সময়মতো পাই না—এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য।”

