logo
ads

সুন্দরবনের সবুজ হৃদয়ে রক্তাক্ত ছায়া: হরিণ শিকারের নতুন কৌশল নিয়ে তৎপর!

মোঃ রোকনুজ্জামান শরীফ, পিরোজপুর থেকে:

প্রকাশকাল: ৪ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৫৬ পি.এম
সুন্দরবনের সবুজ হৃদয়ে রক্তাক্ত ছায়া: হরিণ শিকারের নতুন কৌশল নিয়ে তৎপর!

নিজস্ব

সুন্দরবন—পৃথিবীর সবুজ হৃদয়, যেখানে নদীর স্রোত আর বনের ছায়া মিলেমিশে এক অমূল্য জীবনের সিম্ফনি বাজায়। এই বিশাল ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, যা বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত জুড়ে বিস্তৃত, প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলোমিটারের এক অনন্য জগৎ। এর মধ্যে বাংলাদেশের অংশ ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার, আর ভারতের ৩,৯৮৩ বর্গকিলোমিটার—একটি জীবন্ত ইকোসিস্টেম, যা উইকিপিডিয়ার মতো বিশ্বস্ত সূত্রও অবাক হয়ে বর্ণনা করে। কিন্তু এই সবুজ স্বর্গের গভীরে আজ এক অন্ধকার ছায়া নেমেছে, যা হৃদয়বিদারক: হরিণ শিকারের নির্মম নৃশংসতা। শিকারীরা, যেন ছায়ার মতো অদৃশ্য ভূত, নতুন নতুন কৌশলে হরিণদের জীবনচ্যুত করছে। প্রতিটি ফাঁদ যেন একটি নীরব চিৎকার—সুন্দরবনের আত্মা কাঁদছে, আর আমরা কি শুনতে পাচ্ছি?

সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলায় ছড়িয়ে আছে, দুটি বিভাগে বিভক্ত: পূর্ব বন বিভাগ (বাগেরহাট) এবং পশ্চিম বন বিভাগ (খুলনা)। এখানে ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিচরণ করে, যা এই বনকে এক অনন্য জীবন্ত ক্যানভাসে পরিণত করেছে। ২০১৮ সালের বাঘ শুমারি অনুসারে, পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগে ১ লক্ষ ৪২ হাজার হরিণের উপস্থিতি ছিল—আজ সেই সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে ধারণা। কিন্তু বাগেরহাটের ৫,৮৮২.১৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মধ্যে ১,৮৩৪.৭৪ বর্গকিলোমিটার বনাঞ্চল, যেখানে ছয়টি স্টেশন দাঁড়িয়ে আছে যেন রক্ষকের প্রহরী: বিভাগীয় অফিস (সুন্দরবন পূর্ব, বাগেরহাট), বগী ফরেস্ট অফিস, চাঁদপাই স্টেশন অফিস, জেলেপল্লী টহল ফাঁড়ি (দুবলা), ধানসাগর ফরেস্ট অফিস এবং শরণখোলা স্টেশন অফিস। এই স্টেশনগুলো যেন বনের রক্তনালী, কিন্তু আজ সেই নালীতে বিষাক্ত জল বইছে—হরিণ শিকারের কালো ছায়া।

সুন্দরবনের চারপাশে উত্থিত ভোক্তা শ্রেণির কারণে হরিণের মাংসের চাহিদা আকাশছোঁয়া হয়েছে। সৌখিন বাবুদের প্লেটে যেন রাজকীয় ভোজের অংশ, এই দুর্লভ মাংস। কিন্তু এর পেছনে সংঘবদ্ধ শিকারি চক্রগুলো, যেন রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা নিষ্ঠুর শয়তান, বনবিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে নতুন কৌশল আবিষ্কার করছে। দৃশ্যমান নাইলন রশির পরিবর্তে এখন স্টেইনলেস স্টিলের তার—আলো-ছায়ার এই জটিল নাচে প্রায় অদৃশ্য, যেন মৃত্যুর নীরব জাল। প্রতিনিয়ত এই চক্রগুলো হরিণ নিধন করছে, আর হরিণ পাচার প্রতিরোধে বনরক্ষীদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে—তারা কি যথেষ্ট? না কি এই লড়াইয়ে তারাও একা?

বনসংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, নির্দিষ্ট সময়ে—যেমন শুষ্ক মৌসুমে—হরিণ শিকার বেড়ে যায়। শরণখোলা রেঞ্জের কচিখালি, চান্দেশ্বর, ডিমের চর, পানির ঘাট ও সোনাতলা এলাকা যেন শিকারীদের নিরাপদ করিডর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, বরগুনার পাথরঘাটার চরদোয়ানি, কাঠালতলি, জ্ঞানপাড়া ও মঠবাড়িয়ার বাবুরহাটের চক্রগুলো রাতের আঁধারে এসে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে নিয়ে যায়। শিকারীরা সুন্দরবন থেকে হরিণ এনে শরণখোলার সোনাতলা-পানিরঘাট দিয়ে পাচার করে—একটি নির্মম চেইন, যা জীবনের সুতো ছিন্ন করে।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভয়াবহ সত্য: সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ, মোংলা, রামপাল, খুলনার দাকোপ এবং বরগুনার পাথরঘাটায় একাধিক পেশাদার চক্র সক্রিয়। তারা জেলে, মৌয়াল, কাঠুরিয়া, কাঁকড়া বা ঢেকির শাক সংগ্রাহক সেজে যন্ত্রপাতি খণ্ড খণ্ড করে নিয়ে যায়, পরে একত্র করে ফাঁদ বাঁধে। শিকারের পর সরঞ্জামগুলো গাছের গোড়ায় লুকিয়ে রাখে—যেন পরবর্তী মৃত্যুর জন্য অপেক্ষমাণ অস্ত্র। বনবিভাগের তৎপরতা বাড়ায় এখন চেতনানাশক স্প্রে টোপ হিসেবে ব্যবহার—হরিণের নির্মল চোখে বিষের ছায়া। স্থানীয় মৌয়াল-জেলেরা বলেন, বনবিভাগের কিছু অসাধু কর্মচারী ও প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এই চোরা কারবার চলে।

গত জুন-আগস্টের নিষেধাজ্ঞাকালে সত্ত্বেও ফাঁদ ছড়িয়ে ছিল সর্বত্র। বনবিভাগের সূত্রে: ১৮৯ অভিযোগ, ৯৪ মামলা, ১৪৮ গ্রেপ্তার, ৭ পলাতক, ২৪,০০০ ফুট মালাফাঁদ, ১৩০ ছিটকা ফাঁদ, ৬০০ হাটাফাঁদ উদ্ধার। ১৫৫ বিষ-প্রয়োগকারী মৎস্যশিকারী আটক, হরিণ শিকারীদের বিরুদ্ধে ৮ মামলা, ১০ গ্রেপ্তার, ৪৯ কেজি হরিণ মাংস উদ্ধার, নৌকা-ট্রলার আটক। ‘প্যারালাল লাইন সার্চিং’ দিয়ে বিপুল ফাঁদ জব্দ, পোড়ানো হয়েছে। প্রতিদিন এখনও উদ্ধার চলছে—কিন্তু এ কি যথেষ্ট? সুন্দরবনের আশপাশের মাছের ডিপো ও শুটকির দাদনদাররা জেলেদের উদ্ভূদ্ধ করছে, আর শিকারীরা বনভূমির অভিজ্ঞতায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে টের পেলেই গভীর অরণ্যে মিলিয়ে যায়। শরণখোলা রেঞ্জের সোনাতলা, পূর্ব খুড়িয়াখালী, দাসের ভাড়ানী, চরদুয়ানী, জ্ঞানপাড়া, কাঁঠালতলী, রামপাল, মোংলা, দাকোপ—এসব গ্রামে চক্র সক্রিয়। চাঁদপাই রেঞ্জের মোংলা, ঢাংমারি, ভোজনখালীতেও একই ছবি—জেলে সেজে স্প্রে ব্যবহার করে হরিণ শিকার।

সূত্র বলে, রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মদদ দিচ্ছেন। এক অবৈধ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে, যেখানে সিন্ডিকেট সদস্যরা ১,২০০–১,৮০০ টাকা কেজি দরে মাংস সংগ্রহ করে। হরিণের চামড়া শৌখিনদের বাসায় শোভাবর্ধক—কিন্তু কারও হৃদয় কাঁদে না। শিকারীরা নতুন কৌশল নিচ্ছে, পুরো সুন্দরবন ফাঁদের আওতায়। বনরক্ষীরা, বাঘ-কুমির-সাপের ভয় সত্ত্বেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পায়ে হেঁটে ফাঁদ উদ্ধার করছেন। প্রত্যেককে ১,৮০০ হেক্টর পাহারা—জোয়ারে পথ ডুবে গেলে আগ্নেয়াস্ত্র বেঁধে সাঁতার কেটে। পূর্ব সুন্দরবনের ৪২৬ জনবলের মধ্যে ১৫০-এর সংকট—এ কি ন্যায়?

সুন্দরবনে হরিণের আনাগোনা যেখানে সবচেয়ে বেশি, সেখানেই ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি: কটকা (যেখানে হরিণরা বনরক্ষীদের সাথে অবাধে বিচরণ করে, যেন বিশ্বাসের সেতু), করমজল (পর্যটন কেন্দ্র, মানুষ-হরিণের বন্ধুত্বপূর্ণ নাচ), হিরণ পয়েন্ট (সংরক্ষিত আশ্রয়, বাঘ-হরিণ-বানরের নিরাপদ ঘর), কচিখালী (অবাধ বিচরণের স্বর্গ), সুপতি, ঢাংমারী, কোকিলমুণি, দুবলা অফিস পাড়া। এসব জায়গায় হরিণ যেন স্বাধীন পাখি, কিন্তু আজ ফাঁদের শিকার।

সুন্দরবনে হরিণ শিকারের পেছনে লুকিয়ে আছে একাধিক করুণ কারণ, যা যেন একটি অন্ধকার জালে জড়িয়ে পড়েছে এই সবুজ জগৎ। প্রথমত, অর্থনৈতিক লোভ—হরিণের মাংস ও চামড়ার অদম্য চাহিদা চোরা শিকারিদের লোভকে উস্কে দিচ্ছে, যেন দারিদ্র্যের অন্ধকারে একটি মিথ্যা আলোর প্রলোভন। দ্বিতীয়ত, সহজলভ্যতার সুযোগ—শুষ্ক মৌসুমে খাল-নদীতে পানি কমে যাওয়ায় হরিণের বিচরণক্ষেত্র বিস্তৃত হয়ে ওঠে, এবং তারা যেন খোলা মাঠে লক্ষ্যবস্তু হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, আইন প্রয়োগের দুর্বলতা—অনেক সময় শিকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে, যেন আইনের ছায়ায় এক লুকোচুরির খেলা চলছে। চতুর্থত, স্থানীয় দারিদ্র্যের চাপ—সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার দরিদ্র মানুষেরা পেটের দায়ে এই নৃশংসতায় হাত দিচ্ছে, যা একটি করুণ কান্নার মতো হৃদয় ছুঁয়ে যায়। পঞ্চমত, শিকারীদের অগ্রীম দাদন—মাংসপ্রেমী এক শ্রেণীর মানুষ আগাম টাকা দিয়ে তাদের উৎসাহিত করছে, যেন মৃত্যুর এক বাজার গড়ে উঠেছে। অবশেষে, বনবিভাগের সীমাবদ্ধতা—জনবল ও রক্ষণাবেক্ষণ উপকরণের অভাবে রক্ষকরা যেন একা যোদ্ধার মতো লড়াই করছেন, এই অভাব যেন সবুজের রক্তপাতকে আরও ত্বরান্বিত করছে।

ন্দরবন রক্ষায় এখন দ্রুত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে এই অন্ধকার ছায়া দূর হয়ে সবুজ আলো ফিরে আসে। প্রথমত, বনবিভাগের জনবল ও তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা জরুরি, যেন রক্ষকদের শক্তি বাড়িয়ে অন্ধকারে আলোর সৈন্য গড়ে তোলা যায়। দ্বিতীয়ত, নিরাপদ ও সুরক্ষিত দ্রুতগতির পর্যাপ্ত জলযান সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে জোয়ারের লড়াইয়ে তারা সহায়তা পান। তৃতীয়ত, বনরক্ষীদের অসুস্থতায় দ্রুততম যানবাহন সরবরাহ ও স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা দরকার, যা তাদের জীবনরক্ষার মতো হৃদয়ের যত্ন। চতুর্থত, বনরক্ষীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত, যেন ঘরের ছায়ায় মানসিক শান্তি ফিরে আসে। পঞ্চমত, হরিণ শিকার প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় জীবনরক্ষা উপকরণ সরবরাহ করতে হবে, যাতে বাঘের মুখোমুখি হয়েও সাহস থাকে। ষষ্ঠত, কঠোর শাস্তি ও জরিমানার বিধান রেখে আইন সংশোধন ও প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি, যা নির্মমতার প্রতিশোধের মতো কাজ করবে। সপ্তমত, উর্ধতন বনকর্মকর্তাদের নিয়মিত বন এলাকা পরিদর্শন বাধ্যতামূলক করতে হবে, যেন চোখের নজর সর্বদা থাকে। অষ্টমত, উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করণ—যেমন ড্রোন ও ক্যামেরা—আধুনিক অস্ত্র হিসেবে কাজ করবে। নবমত, বনরক্ষীদের ভালো কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পুরস্কারের ব্যবস্থা চালু করা উচিত, যা উৎসাহের জোয়ার তৈরি করবে। দশমত, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে সমাজের হাত ধরে লড়াই করতে হবে। অবশেষে, বনবিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা দরকার, যাতে কেউ দায়িত্ব এড়াতে না পারে—এই পদক্ষেপগুলো যেন সুন্দরবনের হৃদয়কে পুনরুজ্জীবিত করে।

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগীয় করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবীর বলেন, "সুন্দরবনে হরিণ শিকার সহজে বন্ধ হচ্ছে না, কারণ চতুর্পাশের লোকালয়ের মানুষ মনে করে, আত্মীয়-স্বজনকে হরিণের মাংস খাওয়ালেই বড় অর্জন। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ অবৈধ—যেন বিষাক্ত ফল খাওয়া। এক শ্রেণী অগ্রীম টাকা দিয়ে উৎসাহিত করছে। আটককৃত শিকারীদের কাছ থেকে জানা যায়, উচ্চপদস্থদের আপ্যায়নে অধঃস্থরা হাত দিচ্ছে। মাংসের পোটলায় চামড়া রেখে নিশ্চিত করে, এমনকি শুকরের মাংস হরিণের ছদ্মবেশে চালানো হচ্ছে। কে কী খাচ্ছে—পচা মাংস, শুকর? সবাইকে সচেতন হতে হবে, নিরুৎসাহিত করতে হবে—এটাই একমাত্র পথ।"

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (ডিএফও) মোঃ রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, "জনবল সংকট সত্ত্বেও বনরক্ষীরা কঠোর পরিশ্রম করে পাহারা দিচ্ছে। এক শ্রেণী অসাধু নতুন কৌশলে শিকার করছে। আমরা টহল চালিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু হরিণ রক্ষায় সকলকে এগিয়ে আসতে হবে—এটা আমাদের সকলের দায়িত্ব।"

সুন্দরবনের এই রক্তাক্ত অধ্যায় আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। হরিণরা যেন বনের নির্মল আত্মা—তাদের মৃত্যুতে আমরা সকলে মরছি। এবার সময় সচেতন হওয়ার, লড়াইয়ের। না হলে এই সবুজ হৃদয় থেমে যাবে চিরতরে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ