বিশ্বজুড়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বিশেষ করে বায়ুশক্তি সম্প্রসারণে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় জনগণের বিরোধিতা। বিশেষজ্ঞদের মতে, আদালতের পথে না গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার বা জমির মালিকদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিলে এই বিরোধ দ্রুত, সাশ্রয়ী ও শান্তিপূর্ণভাবে মেটানো সম্ভব।
জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কয়লা, গ্যাস ও তেল নির্ভর জ্বালানি থেকে সরে এসে সৌর ও বায়ুশক্তির দিকে ঝুঁকছে বিশ্ব। সৌরবিদ্যুৎ ইতিমধ্যেই অনেক অঞ্চলে কম খরচে নির্ভরযোগ্য উৎসে পরিণত হয়েছে। তবে বায়ুশক্তি তুলনামূলকভাবে বেশি শক্তি উৎপন্ন করতে পারলেও, সম্প্রসারণের গতি ধীর— মূলত রাজনৈতিক বাধা ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের আপত্তির কারণে।
২০২০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বায়ুশক্তিকে “অত্যন্ত ব্যয়বহুল, পাখি হত্যাকারী ও অনির্ভরযোগ্য” বলে মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (IEA) তথ্য অনুযায়ী, যেখানে স্থায়ী প্রবল বাতাস প্রবাহিত হয়, সেসব অঞ্চলে বায়ুশক্তির উৎপাদন খরচ জীবাশ্ম জ্বালানির চেয়েও কম।
বায়ু টারবাইনে পাখির মৃত্যু হয় বটে, তবে গবেষণা বলছে, বিদ্যুৎ লাইনের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ১ থেকে ৬ কোটি পাখি মারা যায়, আর উঁচু ভবনের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারায় প্রায় ৯৮ কোটি পাখি। তুলনায় উইন্ড টারবাইনের ক্ষতি অনেক কম।
৩৫০ ফুট উঁচু টারবাইনের আওয়াজ, ছায়া বা ঘূর্ণায়মান ব্লেডের কারণে অনেকেই স্বাস্থ্যঝুঁকি ও জমির দাম কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন। অনেকে একে “নট ইন মাই ব্যাকইয়ার্ড” (NIMBY) মনোভাব বললেও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন— স্থানীয় অসন্তোষ উপেক্ষা করলে প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়।
এক জরিপে দেখা গেছে, স্থানীয় আপত্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বায়ুশক্তি প্রকল্পগুলো গড়ে ১৪ মাস দেরিতে সম্পন্ন হয়। ইউরোপের কিছু দেশে অনুমোদন পেতে সময় লাগে ৯ বছর পর্যন্ত।
২০২৩ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নবায়নযোগ্য প্রকল্পের অনুমোদন প্রক্রিয়া দ্রুত করার নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে সফল হতে হলে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সমঝোতা গড়ে তুলতে হবে। এজন্য জার্মানির মতো দেশে নতুন পদ্ধতি চালু হয়েছে— ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের বিদ্যুৎ বিল ছাড়, অথবা প্রকল্পের লাভের অংশ ভাগ করে দেওয়া।
১৮শ শতকে প্রুশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডেরিকের প্রাসাদের পাশে থাকা এক উইন্ডমিলের মালিকের সঙ্গে বিরোধের ঘটনা উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলেন— আদালতের লড়াই নয়, ন্যায়সঙ্গত ক্ষতিপূরণই সমাধানের পথ।
বিশ্ব যদি সত্যিই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে চায়, তবে বায়ুশক্তির সম্প্রসারণে স্থানীয় জনগণকে শত্রু নয়, অংশীদার হিসেবে দেখতে হবে। দ্রুত অনুমোদন নয়, বরং ন্যায্য ক্ষতিপূরণ ও বাস্তব সুবিধাই টেকসই সম্মতির চাবিকাঠি।

